ধর্মের চিপায় নামের বিড়ম্বনা - কাঁধে যখন বিদেশী সাংস্কৃতি

ধর্মের চিপায় নামের বিড়ম্বনা
মজমা'য় তাবিজ বিক্রেতা মলম বিক্রেতার মতো লোকস্বরাগমের আপ্যায়নের জন্য আপনাকে ডাকতে পারবো না তবে এতটুকু নিশ্চিত হাত পা'য়ের মতো চোখ গুটিয়ে চলে যাওয়া পাঠকদের দীর্ঘ লেখা পড়ার শ্রম পণ্ডশ্রম হবে না লেখক হিসেবে অতটুকু আশাবাদী আমি।

এ লেখাতে যে কয়টি বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট তুলে ধরার চেষ্টা করবো তা হলো -
  • মিথ্যাচারের মাধ্যমে এ উপমহাদেশে আরবীয় সংস্কৃতির প্রচলন।
  • পূর্বপুরুষদের অজ্ঞতার দায়ভার একজন মানুষ শিশুকাল হতে বেঁচে থাকা অবধি বহন করে চলা।
  • বিবেকের আদালতে নামের তাৎপর্যয় ।
  • সুন্নত সংস্কৃতি এবং অপসংস্কৃতি ।


একজন মানুষের আজীবন বহন করে চলা একটি বিশেষ্য হলো নাম। মনে করুণ ছোট বেলায় আপনার পিতামাতা অজ্ঞতাবশত আপনার নাম রেখে দিলো "গাধা"। মৃত্যু অবধি এই "গাধা" নামটা নিয়েই আপনার কালপাত করতে হবে।

কি? উদ্ভট লাগছে? আপনি হয়তো ভাবতে পারেন জেনে বুঝে কেউ তার সন্তানের নাম "গাধা" রাখতে পারে না। কিন্তু আমরা অজ্ঞতাবশত নিজেরাই এ'সমস্ত নাম রাখি। কিভাবে তা আস্তে আস্তে খোলাসা করছি।

বাংলাদেশে সাধারণত ধর্মের উপর ভিত্তি করে'ই নাম রাখা হয় যেমন ইসলামি নাম, হিন্দু নাম, খ্রিষ্টান নাম। ব্যাপারটা কতখানি যুক্তিযোগ্য তা আমি মধ্যপন্থী হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করবো।

একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি-
বাচ্চাদের প্রতি ঝোঁকটা আমার কম দিনের নয়। যদি ও স্বর্গীয় ফরগীয় আমি বিশ্বাস  করি না তবুও বাচ্চা দেখলে মনে হয় স্বর্গীয় অবতার । বাচ্চাদের সাথে আমার আবার  জমে'ও ভালো। যা ই হোক মূল ঘটনায় আসি প্রচন্ড চাপ ঠেলে লেগুনা'য় উঠলাম। ঢাকা শহরে লেগুনা'কে বলা চলে গরীবের মাসিহা। আমার ঠিক সামনের সিটে বোরখা পরা একজন মহিলা বসা চোখ দুটো ছাড়া কিছুই দেখা যায় না তার কোলে প্রচন্ড আদুরে একটা শিশু ঘুমে কাতর হয়ে আছে। ছোটবেলায় মায়ের মুখে রুপকথার গল্প শুনেছিলাম সাগর নাকি কাছে টানে এইরকম কিছু শিশু দেখলেই বোধহয় তারা শুধু কাছে টানে। কয়েকবার ভেংচি কাটায় শিশুটি চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে কয়েকবার পায়ের আঙুল ধরে ও টান দিয়েছি।

আমাকে ছোঁয়ার জন্য শিশুটি হাত বাড়িয়েছিলো। আমার ও খুব ইচ্ছে করছিলো শিশুটিকে স্পর্শ করবার তৎক্ষণাৎ পুরনো একটি স্মৃতি আমার মস্তিষ্ক চারণ করলো রাজধানীর পল্টন এলাকায় একবার খুব আদুরে একটা শিশুকে আদর করার অনুমতি চাওয়ায় তার পিতামাতার কড়া সূর শুনতে হয়েছিলো। থাক সে হৃদয় বিদারক কাহিনী আর মনে করতে চাই
না। অত:পর বোরখা পরা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম - ওর নাম কি?
বললেন - হুরায়রা।
কিছুটা ব্যাথিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম - কে দিয়েছে নাম?
উনি জবাব দিলেন - ওর বাবা।
অপরিচিতদের সাথে বাড়তি কথাবার্তা আমি তেমন পছন্দ করি না তাই উনাকে নাম
সংক্রান্ত জটিলতায় ফেলিনি।
শুধু বলে দিয়েছি ওর বাবাকে একটু জিজ্ঞেস করবেন এ নামের বাংলা অর্থ কি।

যেহেতু নামের সাথে ধর্মের একটা যোগসূত্র আছে তাহলে চলুন এবার একটু আরবীয়
ইতিহাস দেখে আসি। ইসলাম গ্রহণের পর নবী মুহাম্মদের অনেক সাহাবি'র নাম তখনকার অনেক পৌত্তলিক বা
ইহুদী খৃষ্টানদের নামে ছিলো । যেমন ধরেন নবী মুহাম্মদের দুজন দাসীর নাম ছিলো মারিয়া এবং রিহানা। আরবে তখন মারিয়া এবং রিহানা নামক মুসলিম নারী ও ছিলো আবার ইহুদী নারীর নাম ও ছিলো । ধর্ম গ্রহণ বা পরিবর্তনের আগে পরে কারো নামের'ই কোনো পরিবর্তন হয়'নি।

সাদ্দাম হোসেনের খুব কাছের একজন বন্ধু্র নাম তারেক আজিজ । সাদ্দাম হোসেনের পরামর্শদাতা এবং ইরাকের বিখ্যাত রাজনিতিবীদ।নাম মুসলিম টাইপের হলেও তিনি ছিলেন ক্যালিডিয়ান খ্রিষ্টান। সুতরাং এ কথা এখন স্পষ্ট যে নামের কোনো ধর্ম নেই। নাম কোনো ধর্মের ব্যাক্তিগত সম্পদ নয়। নবী মুহাম্মদের জন্মের পূর্ব হতেই মক্কাবাসীরা তাদের পূর্বপুরুষদের নামের সাথে সংযুক্ত রেখে নাম রাখতো অন্তত দশপূরুষ পর্যন্ত তারা মনে রাখতো মজার ব্যাপার হচ্ছে মক্কাবাসীরা পশুপাখির সাথে মিলিয়ে ও নাম রাখতো এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম পশুপাখির সহিত মিলিয়ে নাম রাখা সংস্কৃতি চালিয়ে যেত।

যেমন ধরুন, আমার বাবার নাম বকর। তাহলে আমাকে ডাকা হবে রিয়াজ বিন বকর। এবার আসুন উল্লেখিত ঘটনার সহিত সম্পৃক্ত দুটি আরবী নামের অর্থ জেনে নেই।

আবু হুরায়রা= বিড়ালের পিতা

আবু বকর= ছাগলের পিতা ।

এই রকম কুরানের সূরার নামের ক্ষেত্রে ও হয়েছে যেমন ধরেন - বাকারা শব্দের অর্থ " গবাদিপশু "।

ঘাড়ের উপর দেড় কেজি ওজনের মস্তিষ্ক খাটিয়ে আপনার বিবেক কি অনুমতি দেবে আপনার সন্তানের নাম "বিড়ালের পিতা" "ছাগলের পিতা" এ সমস্ত নাম রাখার? প্রশ্ন রইলো আপনার কাছে।

এ দুটো নাম শুধুমাত্র উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে এ'রকম অসংখ্য আরবী নাম রয়েছে যা আমরা এখনো নিজেদের সন্তানদের নাম রেখে আসছি ।

আমাদের বলা চলে "আমরা হুজুগে মাতাল" । এ হুজুগে মাতাল নিয়ে একটি ছোট্ট গল্প বলা যাক-

আন্তা ইবনে সাদ্দাত, আসমা বিনতে মারওয়ান, আব্দুল আজিজ সহ বেশ কিছু কবির কবিতা আবৃতি ছোট বোনের ফোনে সংরক্ষণ করে রেখেছি সেগুলো লেখা হয়েছিলো নবী মুহাম্মদের বাবা'র দাদা'র আমলে (আসমা ব্যাতিত) ।
কুরানের আয়াতের মতো টেনে টেনে আবৃতিকে পরিবারের সবাই ভাবলেন আল্লাহ্‌ পাক বোধহয় হেদায়েত দান করেছেন তাই আমি কুরান তিলাওয়াত শুনছি। সবার কানাঘোসা দেখে জিজ্ঞেস করলাম- কি শুনছেন? উত্তর দিলেন- কি মধুর কুরানের আয়াত। শুনলেই প্রাণ জুড়ায়।

বুঝতে'ই পারছেন আমাদের অজ্ঞতার স্থান কত গভীরে। শতকরা হিসেব করে আমি ধর্ম অধর্ম বিচার করি না তবুও বলা লাগে এদেশের বেশিরভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো একটু বেশি'ই অজ্ঞ এবং কট্টরপন্থী।


এবার আসুন দেখে নেই নাম রাখা সম্পর্কে ইসলাম কি বলে বা নবী মুহাম্মদ নাম রাখা সম্পর্কে কি কি বলে গেছেন। নাম রাখা সম্পর্কে কঠোর বিধিনিষেধ বা নির্দেশনা ইসলাম কখনো দিয়েছে কি না তা আমার জানা দেই তবে কিছু জাঈফ হাদিস হাসান হাদিস আছে সেগুলো ইসলাম তেমন গুরত্ব দেয় না।

তবে মুসলিম শরিফের নিম্নোক্ত হাদিসটি সকল স্কলারদের কাছেই গ্রহণযোগ্য এবং সত্য বলে মনে হয়েছে -

ইবনু উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নাম হচ্ছে- আব্দুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা) ও  আব্দুর রহমান (রহমানের বান্দা)।”
- [সহীহ মুসলিম] হাদিস- ৫৪০২

আব্দ শব্দের অর্থ বান্দা । সে সূত্রে আপনি আপনার সন্তানের নামের পূর্বে আব্দ শব্দটি ব্যাবহার করতে পারবেন। যেমন ধরুন-

আব্দুল কারীম (সম্মানিতের বান্দা)
আব্দুর রহীম (করুণাময়ের বান্দা)

অনুরুপ, "আব্দুন নবী" বা এইরুপ বহু নামকে ইসলাম হারাম করেছে মাখরুহ করেছে যার কোনো লিখিত দলিল আছে বলে মনে হয় না। ইসলামের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে গেলে এসব আমার শুধু বেদআত ই মনে হবে।

গুগলে সার্চ দিয়ে আপনি ইসলামের মাখরুহ নাম দেখতে পাবেন, হারাম নাম গুলো ও পাবেন উত্তম নামগুলো ও পাবেন । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলাম নাম সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা দিয়েছে বলে মনে হয় না। এর মধ্যে উপরে উল্লেখিত মুসলিম হাদিসটির  হাদিসের মান সম্পূর্ণ সহিহ। শয়তানের নাম রাখা হারাম, উপাসকের নাম রাখা হারাম, চন্দ্র সূর্যের বান্দা ইত্যাদি নাম রাখার হারামের গ্রহণযোগ্য দলিল কতখানি সত্য তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যাক এব্যাপারে আমি স্কলার নই সুতরাং এ ব্যাপারে আর কথা না বাড়াই।

এবার আসি সুন্নত এবং সংস্কৃতি বিষয়ে -
সংস্কৃতি একটি দেশের ভৌগোলিক, সামাজিক, জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত হয় । আরেকটু স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে ভৌগোলিক, সামাজিক, জৈবিকসহ নানান বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রতিটি দেশের সংস্কৃতি পৃথক পৃথক ভাবে গঠিত হয়। নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশে বসে আমরা মরুভুমির দেশ আরবের সংস্কৃতি অনুকরণ অনুশীলন করি তা নিছক হাস্যকর। তারা খেজুর খায় বলে আমরা ও খেজুরকে সুন্নতি ফল মনে করি ভৌগলিক অবস্থানের কারনে আরবদের পরা জুব্বা পায়জামা আমরা সুন্নতি পোষাক মনে করি।

সে সুত্রে বলা লাগে, নবী মুহাম্মদের জন্ম আরবে না হয়ে আইসল্যান্ডে হলে আমাদের হয়তো আজ উল দিয়ে বানানো আপাদমস্তক জ্যাকেট পরে থাকতে হতো শীত গ্রীষ্ম বরষায় জ্যাকেট আর জ্যাকেট আবার আফ্রিকান জঙ্গলের কোনো বর্বর গোষ্ঠীতে হলে হয়তো পশু'র ছাল পরে থাকতে হতো শীত গ্রীষ্ম বরষায় শুধু ছাল বাকল ।

পরিশেষে আপনার সন্তানের সুন্দর বাংলা নাম এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করছি।

লেখক - রিয়াজ মোহাম্মাদ নোমান
Previous Post
Next Post
Related Posts

0 Comments: