ইসলামের গোড়ামি এবং একটি নিরীহ প্রাণীর জীবন

সাপ সম্পর্কে ইসলাম

"ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি এ ভয়ে সাপকে ছেড়ে দেবে যে, সে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। কেননা, যখন থেকে আমরা সাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি, তখন থেকে আমরা সাপ হতে নিরাপদ নই।"
 - সূনান আবু দাউদ (ইফাঃ) / অধ্যায়ঃ ৩৮/ সালাম হাদিস নম্বরঃ ৫১৫৮

"সাপ" শব্দটি শুনলেই অনেকে চমকে উঠে। যেনো কোনো অশুভ শক্তির প্রতীক। অনেকে তো প্রতিপক্ষকে "কালসাপ" বলে গালি দিয়েও বসে। সাপ দেখলেই, ঝাপিয়ে পড়ে মারার জন্য। আসলে সাপ কি সত্যিই আমাদের শত্রু? নাকি কোনো অন্ধবিশ্বাস এর পেছনে কলকাঠি নেড়ে আসছে?


প্রকৃতপক্ষে, সাপ একটি নিরীহ সরীসৃপ প্রাণী। কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া এরা আঘাত বা বাধা না পেলে কাউকে আক্রমণ করেনা। কোনো উপায় না পেয়ে এরা কামড় দিতে বাধ্য হয়। সাপ পরিবেশের বন্ধু, আমাদেরও বন্ধু। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধরে রাখতে সাপের অবদান অসীম। পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ এবং ইদুর সাপের প্রধান খাবার। সাপ এগুলো না খেলে আমরা হয়তো টিকতে পারতাম না। সাপের অপকারিতার চেয়ে উপকারিতা অনেক অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও আমরা সাপ কেনো হত্যা করি?

দাদী-নানী সহ প্রায় সকলের মুখে শুনতাম, ইসলামের নবী মুহাম্মাদের হিজরতের সময় কাফেরদের হাত থেকে বাচার জন্য তাঁর সাহাবী আবুবকরকে নিয়ে এক গুহায় পলায়ন করে। এসময় একটি সাপ আবুবকরকে কামড় দেয়। এ ঘটনা বা হাদিস প্রায় সকলের জানা এবং এই ধারনা থেকেই মুখে মুখে প্রচার হয় সাপ মারা সুন্নাত। আমার আশেপাশে সবাই বিশ্বাস করে সাপ মারলে আল্লাহ খুশি হয় এবং অনেক সওয়াব দেয়। আমিও তাই জানতাম। এবং ছোটবেলা না বুঝে অনেক সাপ মেরেছি। তাহলে আমার এই না বুঝে নিরীহ প্রাণী হত্যার দায় নিবে কে?  নিশ্চই ইসলাম!

তখন অনলাইন ঘেটে সত্যতা পাওয়ার কোনো উপায় ছিলো না যে, সাপ মারলে আসলে সওয়াব হয় কিনা। কারন তখনতো মোবাইল কি সেটাই জানতাম না। অনলাইন তো অনেক দুরের কথা। চোখের সামনে অনেক সাপকে হত্যা করতে দেখেছি। গ্রাম এলাকায় সাপ মেরে পুড়িয়ে ফেলা হয়, যেনো তারা প্রতিশোধ না নিতে পারে। অবুলা এই প্রাণীর ঘাড়ে এই "প্রতিশোধ" এর কলঙ্ক কে ঝুলিয়েছে, আসুন খুজে বের করি।

"হজরত ইয়াজিদ ইবনে মাওহাব (রহ.) আবু সাইদ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন—একদা আমি আবু সাঈদ খুদরি (রা.)-এর কাছে এসে বসি। এ সময় আমি তাঁর চৌকির নিচে কিছুর আওয়াজ শুনতে পাই। আমি তাকিয়ে দেখি যে একটি সাপ। তখন আমি দাঁড়ালে আবু সাইদ (রা.) জিজ্ঞাসা করেন, তোমার কী হয়েছে? তখন আমি বললাম, এখানে একটা সাপ আছে। তিনি বলেন, তুমি কী করতে চাও? তখন আমি বললাম, আমি তাকে মেরে ফেলব। তখন তিনি তাঁর বাড়ির একটি ঘরের দিকে ইশারা করে বলেন, এখানে আমার চাচাতো ভাই থাকত। খন্দকের যুদ্ধের সময় সে রাসুল (সা.)-এর কাছে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুমতি চায়। কেননা সে তখন নতুন বিয়ে করেছিল। তখন রাসুল (সা.) তাকে অনুমতি দেন এবং বলেন, তুমি তোমার হাতিয়ার নিয়ে যাও। সে নিজ ঘরে ফিরে তার স্ত্রীকে ঘরের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে তার (স্ত্রীর) প্রতি কলম দিয়ে ইশারা করে। তখন তার স্ত্রী বলল, তাড়াহুড়ো কোরো না। এসে দেখো কী যেন আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। তখন সে ঘরে ঢুকে একটি কুিসত সাপ দেখতে পায়। সে তাকে বল্লম দিয়ে হত্যা করে এবং বল্লমে তার দেহ ফুঁড়ে বাইরে নিয়ে আসে।

বর্ণনাকারী বলেন, আমি জানি না, এরপর কে আগে মারা গিয়েছিল—লোকটি, না সাপটি। তখন তার জাতির লোকেরা রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলেছে, আপনি দোয়া করুন, যাতে আমাদের সঙ্গী বেঁচে যায়। তখন নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করো।’ এরপর তিনি বলেন, ‘মদিনার একদল জিন ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাই তোমরা যখন তাদের (সাপ) কাউকে দেখবে, তখন তাকে তিনবার ভীতি প্রদর্শন করবে যে আর বের হবে না, অন্যথায় মারা পড়বে। এরপর যদি সে (গর্ত থেকে) বের হয়, তখন তাকে মেরে ফেলবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৬৭)"

উপরের হাদিসটিতে বলা হয়েছে, জিনেরা সাপ হয়ে মানুষের সামনে আসে। এবং তাদের তিন বার ভয় দিলেও যদি বের না হয় তাহলে বুঝতে হবে ওটা জিন না, অরিজিনাল সাপ। এবং তাকে মেরে ফেলতে হবে। তার অর্থ হচ্ছে, ইসলামে সাপ মারতে বলা হয়। ইসলামী ভাস্যমতে যেহেতু জিনেরা সাপ হয়ে আসে সেহেতু তারা প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

তাহলে পাঠক কি বুঝলেন? একটি গোড়ামি উক্তিকে কেন্দ্র করে, পরিবেশের একটি অন্যতম উপাদান এবং একটি প্রাণীকে নির্বিচারে হত্যা করে, নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চলছে।

সাপ কি সত্যিই প্রতিশোধ নেয়? সাপ কি তার শত্রুকে চিনে রাখে? উত্তর - না। সাপের মস্তিস্ক খুবই ছোট। এবং এটা অবশ্যই সম্ভব।  কিন্তু তা হতে হবে কোনও সস্তার সিনেমা বা অতি খাস্তা বাংলা বা হিন্দি সিরিয়াল। সাপের স্মৃতিশক্তি বা বুদ্ধি নেই। এবং এরা কিছুই মনে রাখতে পারেনা। তারা শুধু এটুকু জানে, বাঁচতে গেলে খেতে হয়, খেতে গেলে হত্যা করতে হয়। নিজের শক্তি সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। নিজের আকার সম্পর্কে সাপ ওয়াকিবহাল। আর রয়েছে যৌনতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। সাপ মানেই বিষধর নয়। পৃথিবীতে প্রায় ২৫০০ থেকে ৩০০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৫০০ প্রজাতির সাপ বিষধর। আমাদের দেশে প্রায় ১০০ প্রজাতির সাপ থাকলেও বিষধর সাপ রয়েছে মাত্র ২০ প্রজাতির।

আসুন আরও একটি হাদিস দেখি -

আমর ইবনু মুহাম্মদ আন নাকিদ (রহ.) তার বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘সব সাপ মেরে ফেলো।  বিশেষ করে পিঠে দুটি সাদা রেখাবিশিষ্ট ও লেজ কাটা সাপ।  কেননা এ দুটি গর্ভপাত ঘটায় এবং দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেয়।’ 

বর্ণনাকারী বলেন, ‘ইবনে ওমর (রা.) যে কোনো সাপ দেখলে মেরে ফেলতেন।  একদিন আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনজির (রহ.) তাকে দেখলেন যে, তিনি একটি সাপ ধাওয়া করছেন।  তখন তিনি বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বাড়িঘরে অবস্থানকারী সাপ মারতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম : ৫৬৩১)। 

বিশিষ্ট কলা বিজ্ঞানী (চায়ের দোকানের বিজ্ঞানী) ছাড়া এ উক্তি কোনো সুস্থ/শিক্ষিত মানুষের পক্ষে করা সম্ভব না যে, সাপের পিঠের সাদা দাগ ও লেজ কাটা, গর্ভপাত ঘটায় আর মানুষের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়ে অন্ধ বানিয়ে দেয়। আজ পর্যন্ত এমন কোনো রোগী পৃথিবীতে দেখা গিয়েছে কিনা আমার জানা নাই। একটা নিরীহ প্রাণীর পিঠে এতো মিথ্যা অপবাদ চাপাতে তাদের কিঞ্চিৎ পরিমাণ দ্বিধাবোধ হয়নি। আর হবেই বা কেনো? তাদের মতে মানুষ পৃথিবীর সেরা জীব। দুঃখিত। মানুষ না পুরুষ। আর বাকিরা তাদের ভোগ্য বস্তু।

লেখক - মোমিন শেখ
Previous Post
Next Post
Related Posts

1 comment:

  1. অল্প একটু জ্ঞান নিয়ে, জ্ঞানের অহংকার করে মুর্খ্যরা। ইসলাম সসম্পর্কে বিস্তারিত জেনে মন্তব্য করলে হয়ত আপনিই একজন ইমানদার ব্যক্তি হয়ে যেতেন।

    ReplyDelete