দুর্গা প্রতিমা তৈরীতে পতিতালয়ের মাটি এবং পৌরাণিক এক পতিতার জয়গাঁথা

দেবী দুর্গা
বাংলায় শারদীয় দুর্গোৎসব চলছে। শাস্ত্র বলে দুর্গতিনাশিনী দুর্গাদেবীর মায়ের আদল ফুটিয়ে তুলতে কয়েকটি জিনিষ আবশ্যক৷ যেমন, গোমূত্র, গোবর, ধানের শিষ, পবিত্র গঙ্গার জল আর নিষিদ্ধপল্লীর মাটির মিশ্রণে তৈরি হবে দেবীমূর্তি৷ আর এই কারণেই সেই পুরাকাল থেকে আজও দেবীর মূর্তি তৈরিতে দরকার হয় বেশ্যালয়ের মাটি ৷ কিন্তু কেন এই রীতি ? সমাজ যাঁদের দূরে ঠেলে দিয়েছে, অবজ্ঞা আর বঞ্চনার পাহাড় জমে উঠেছে যাঁদের দেওয়াল বেয়ে, ঘৃণা আর নোংরা দৃষ্টি ছাড়া যাঁদের ভাগ্যে আর কিছুই জোটেনি, তাঁদের ঘরের মাটিই আবার দেবীমূর্তির অপরিহার্য অঙ্গ৷ কিন্তু কেন?
‘যেখানে উড়ে রুদ্রের চিঠি, বোদলেয়ারের মেঘদল
যেখানে বিসর্জিত নারী-পুরুষের অর্জিত বোধ সকল
যে ঘর অনাহূতেরে ডাকে আহূতের সুরে-স্বরে
পতিতালয়ের প্রবেশদোরেই শুদ্ধতম মাটি আছে পড়ে"!

দুর্গা পূজার মহাস্নানে ‘বেশ্যাদ্বারের মাটি’ লাগে ৷ সংস্কৃত শব্দের অর্থ না জানার ফলে নাকি বিভ্রান্তিতে পড়ছে অনেকে৷

“অভিষিক্তা ভবেৎ বেশ্যা ন বেশ্যা কুলটা প্রিয়ে”। -মহানির্ববান তন্ত্র৷

“পূর্ণাভিষেকো দেবেশি দশ বিদ্যাবিধোস্মৃত” দশ মহাবিদ্যার উপাসকগণই পূর্ণাভিষেকে অধিকারি অন্যে নহে৷—কুলার্ণব তন্ত্র ৷

দীক্ষা পুরশ্চরণঃ পূর্ণাভিষেক মন্ত্রচৈতন্য হওয়ার ফলে যিনি দেবত্বে উন্নীত হয়েছেন, এরকম অভিষিক্তাকে বেশ্যা বলা হয়েছে, অার উনারা যেখানে বাস করেন সেই দ্বারের মাটিকে বলা হয়েছে পবিত্র মাটি৷

একটা পুরুষ যখন পতিতার বাড়ি গিয়ে অবৈধ যৌনাচার করে তখন ঐ পুরুষের জীবনের সমস্ত পূণ্য পতিতার বাড়ির মাটিতে পতিত হয় বা পূণ্য তাকে ত্যাগ করে, বিনিময়ে ঐ পুরুষ পতিতার ঘর থেকে নিয়ে আসে তাঁর সমস্ত পাপ। এরূপ বহু পুরুষের অর্জিত সমস্ত পূণ্য ত্যাগে পতিতাদের ঘরের মাটি পূণ্যময় হয় বলে মনে করা হয়, তাই পতিতার ঘরের পবিত্র মাটি প্রয়োজন হয় দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরীতে।

দেবী দুর্গা কে? দেবদ্রোহী মহিষাসুর নামে অসুরকে ব্রহ্মা বর দিয়ে ফেলেছিলেন যে, কোনও পুরুষ তাকে বধ করতে পারবে না। এরপর সে মনের আনন্দে দেবতাদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার শুরু করলে ভোগবাদী বৈদিক দেবতারা অবশেষে স্বর্গচ্যুত হন। উত্ত্যক্ত, ব্যতিব্যস্ত দেবতারা দেখলেন, অতিসত্বর এর একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার। তারা নিজেরা কেউ এই দানবের সঙ্গে লড়তে পারবেন না, তার বদলে প্রবল শক্তিশালিনী এক নারীকে সৃষ্টি করতে হবে। তখন অনেকেই তাদের তেজের অংশ দান করলেন।

শিবের তেজে হল মুখ, বিষ্ণুর তেজে দশটি বাহু, চন্দ্রের তেজে দুই স্তন, ইন্দ্রের তেজে কোমর, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, বসুগণের তেজে আঙুল, কুবেরের তেজে নাক, প্রজাপতির তেজে দাঁত, সন্ধ্যার তেজে দুই ভুরু ও পবনের তেজে দুই কান। এই গঠন প্রক্রিয়ায় বেশ একটা কৌতূহলী দিকও আছে। দেবতারা পরে তাঁদের নিজেদের অস্ত্র এই দেবীকে দান করেন, তাই দেবী একাধিক অস্ত্রে সজ্জিত।

তবে কি সকল দেবতা এই প্রতারক এবং ছলনাময়ী দুর্গা দেবী তৈরীতে কোন আর্য নারীর সাথে পর্যায়ক্রমে যৌন সংশ্রবে মিলিত হয়ে তাকে তেজ প্রদান করেছিলেন, সোজা বাংলায় একাধিক পুরুষের সাথে মিলিত হলে যাকে আমরা পতিতা বা বেশ্যা বলি? দুর্গাপুজার আড়ালে কি এমনই কোন ছলনাময়ী প্রতারক দেবী পতিতারই পুজো করা হচ্ছে? আর অসুরদের দেখা হচ্ছে অত্যাচারী, দেবদ্রোহী, বেদবিরোধী অযাজ্ঞিক অধার্মিক হিসাবে।

শতপথ ব্রাহ্মণ বলছে “যজ্ঞেন বৈ দেবাঃ” যারা যজ্ঞ করতেন তারা দেব। দেবতা কথার অর্থ বিদ্বান ব্যক্তি, বিদ্যাংসো হি দেবাঃ(শতপথ ব্রাহ্মণ), বিদ্বান তিন প্রকার দেব,ঋষি,পিতৃ।

অসুর শব্দের অর্থ বীর, যোদ্ধা, জাজ্বল্যমান। অসুর কোন নিন্দা সূচক শব্দ না ঋগ্বেদে বহুবার প্রশংসা সূচক অভিবাদন স্বরূপ ইন্দ্র, সূর্য, বরুণ কে অসুর সম্ভাষণ করা হয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে দেবাসুরের সংগ্রামের কথা পাই, সেটা বাস্তবে শক্তির সঙ্গে প্রজ্ঞার লড়াই ছিল, যেখানে বিদ্বানরা জয় লাভ করে ছিল, আর বীর যোদ্ধা অসুরেরা পরাজিত হয়ে আর্য্যবর্ত ত্যাগ করে পশ্চিমে আ্যসিরিয় সভ্যতা স্থাপন করেছিল। কিন্তু আজ ইতিহাস বিকৃতির ফলে দেবতা বলতে অপার্থিব মহান শক্তি ও অসুর বলতে অদ্ভুত অত্যাচারী কিছু অমানবের প্রতিচ্ছবি বোঝায়।

আসলে দেব বা অসুররা আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ। এরা দুইদল ভারতেরই দুইটি সুপ্রাচীন আর্য জাতি। তবে একদল যাজ্ঞিক, আর অন্যদল যজ্ঞ রহিত। বেদে ১০৫ বার অসুর শব্দের উল্লেখ আছে। তার মধ্যে ৯০ বারই প্রশংসা সূচক। যেমন অসুরঃ অসু ক্ষেপণে শত্রুণ্ ইত্যসুরঃ। যারা শত্রুদের উপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে পটু তারা অসুর। এবং অসুন্ প্রাণান রাতি দদাতি ইত্যসুরঃ। যারা প্রাণদান করে, যাদের মধ্যে দুর্দমনীয় প্রাণশক্তির প্রকাশ দেখা যায়, সেই সমস্ত শক্তিশালী বীররাই অসুরপদবাচ্য।

ড: নীহার রঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস ’ গ্রন্থেও এ কথা স্বীকার করেছেন । বৈদিক যুগে আর্যরা বিহারের মিথিলা পর্যন্ত দখল করলেও শেষ পর্যন্ত তারা পূর্ব-ভারতের আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুর জাতির কাছে বারবার পরাজিত হয়ে পূর্বভারত দখলের যাবতীয় স্বপ্ন একসময় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ এই অসুর জাতির যেমন ছিল এক বিশাল হস্তিবাহিনী তেমনি ছিল তাদের শক্তিশালী এক রাজতন্ত্রও। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে(১/১৪) এই অসুর জাতির রাজতন্ত্রের মধ্যে একমাত্র প্রাচ্যদেশেই এই একরাট বা সম্রাট ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। যেহেতু অসুর রাজতন্ত্রের সর্বাধিনায়ককে সম্রাট বলা হত সেহেতু বৌদ্ধ যুগে অসুর জাতির বংশধর হিসাবে সম্ভবত: মৌর্য শাসকদের সর্বাধিনায়কের উপাধিও ছিল সম্রাট। তবে সুচতুর নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা পরাজিত আলপাইন অসুর জাতির লোকদের দেবতার ভয়ে ভীত করে চিরদিনের মত দাবিয়ে রাখতে তাদেরই সৃষ্ট কাল্পনিক দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটিয়ে এই অসুরদের রাজত্ব বঙ্গদেশে ব্যাপকভাবে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন; যা ভারতবর্ষের আর কোন রাজ্যে তেমন দেখা যায় না। কাল্পনিক এই দুর্গার আসরে অসুরদের এমন ভাবে তারা অত্যাচারী এবং অশুভ শক্তির ধারক ও বাহকরূপে প্রকাশ করেন যাতে ভবিষ্যতে কোন বাঙালি যেন ঘৃণা ভরে কোনদিনও জানতে না চান যে আসলে তারাই হল আলপাইন অসুর জাতির মানুষ।

এবার ফিরে আসা যাক পতিতা প্রসঙ্গে, পতিতাদের কদর এবং উদাহরন হিন্দু পুরাণে ভুঁড়ি-ভুঁড়ি! তাছাড়া হিন্দু পুরাণে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে পতিতাদের ক্ষমতা নাকি দেবতা বা বৈদিক বিদ্বান নেতাদের থেকেও বেশী। কালীদাস রচিত শকুন্তলায় আছে- বিশ্বামিত্র ঋষি ইন্দ্রত্ব লাভের আশায় তপস্যা করছিল। তখন ইন্দ্র ভীত হয়ে মেনকাকে পাঠায় বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য। মেনকা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে বিশ্বামিত্রের সামনে যায়, ফলে বিশ্বামিত্র তপস্যা ভুলে মেনকার সাথে যৌন-সংশ্রবে মিলিত হয়। এই মিলনের ফলে শকুন্তলার জন্ম হয়। দেবরাজ ইন্দ্র সর্বশক্তিমান হয়েও যা করতে পারলেন না, মেনকা সামান্য নারী হয়ে তা অবলীলায় করে ফেলল!

তেমনি এই দুর্গা চরিত্র, নোংরা ছলনার দ্বারা বীর মহিষাসুরকে নিরস্ত্র করে হত্যা করে। ঋগবেদের ১.১০৮.৮ শ্লোক অনুযায়ী জানা যায়, আর্য গোষ্ঠী গুলির মধ্যে পাঁচটি মূল গোষ্ঠীর, যেমন-পুরু, যদু, তরবাসা, অনু এবং দ্রুহয়ু- এর সঙ্গে অনার্য বীর রাজা মহিষাসুরের বারবার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে এই আর্য গোষ্ঠী গুলি বেশ কয়েকবার পরাজিত হলে তারা একত্রে বসে পরামর্শ করে নৃত্য -গীতে পারদর্শী সুন্দরি কামিনী-নারী দুর্গাকে মহিষাসুরের কাছে পাঠায়। অসুরজাতি নারীকে আক্রমণ করত না। রাজা মহিষাসুর যখন অস্ত্র ত্যাগ করে শয়ন কক্ষে যান, ঠিক তখন-ই নিভৃত ঘরে ছলনাময়ী-কামিনী দুর্গা তাকে হত্যা করে আর্যদের বিজয় গাঁথা রচনা করে। ছলনাময়ী নারী দুর্গা অসুরদের বীরসম্রাট মহিষাসুরের বুকে ত্রিশূল দিয়ে বিঁধে, বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার অনুগত অন্যান্য হিংস্র পশুরা তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। ব্রাহ্মন্যবাদী সংস্কৃতি বৈদিক বামুনেরা দলিত ও অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেনীর মানুষের উপর ছলে-বলে-কলে-কৌশলে চাপিয়ে দিয়েছে এবং মূলনিবাসীদের সংস্কৃতিকে নৃশংসভাবে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে অনেকেই নিজেদের উৎস ও অতীত ইতিহাস ভুলে গিয়ে আজ বৈদিক বেশ্যা দুর্গাকে মাতৃজ্ঞানে বন্দনা করেন।

অথচ হিন্দু সমাজেও এই বেশ্যাদের বেশ কদর ছিলো বরাবরই। কারণ ঐ যে, দেবতাদের চেয়েও পতিতার শক্তি বেশী। উল্লেখ্য ব্রিটিশ আমলে পতিতাদের জন্য এই কলকাতা শহর কিন্তু ছিল খুব বিখ্যাত। ব্রিটিশদের হস্তগত করতে পতিতার প্রলোভন দেয়া হয়, তাই বাংলায় পুনরায় পতিতাদেবী দুর্গা পুজোর প্রচলন শুরু হয় এই ব্রিটিশ আমলেই। বহিরাগত মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে কোনক্রমে পেরে না ওঠা অবস্থাপন্ন হিন্দু জমিদারগণ অবশেষে পতিতাদেবীর পুজোর আয়োজন অন্তত তাই প্রমাণ করে। বিখ্যাত(!) পতিতালয় সোনাগাছি-তো এই শহর কলকাতাতেই অবস্থিত। এ সম্পর্কে ইতিহাস বলে-
"কলকাতায় খুবই রমরমা ছিল বেশ্যাদের জগৎ। গৃহস্থের বাড়ির পাশে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, চিকিৎসালয়ের পাশে বেশ্যা, মন্দিরের পাশে বেশ্যা"। [তথ্যসুত্র: বিনয় ঘোষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত,১৯৯৯, পৃ. ৩০২-০৩]
Previous Post
Next Post
Related Posts

0 Comments: