নারীর পোষাকের অন্তরালে লজ্জা আর যৌনতার সুঘ্রাণ

নারীর পোষাকের অন্তরালে যৌনতা
বাংলাদেশের সমাজে অনেকেই বলে থাকেন যে পুরুষদের পোশাক পরার স্বাধীনতা আছে
কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে নেই, আমি বলতে চাই বাংলাদেশে নারী-পুরুষ কারো  ক্ষেত্রেই পোশাক পরার স্বাধীনতা নেই, পুরুষতন্ত্রবাদী নিয়মনীতির যাঁতাকলে পুরুষেরাও চাইলেই হাফ-প্যান্ট পরে যেখানে সেখানে যেতে পারেনা, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেতে পারলেও সেই কোনো কোনো ক্ষেত্র হয়ে থাকে শুধুই তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ক্ষেত্রে। হাফ-প্যান্ট পরে অফিসে গেলে তো চাকরিটাই শেষ। আর উপহার হিসেবে অভদ্র তকমা ফ্রী।

আমি একজন নারী, আমি ছোটো বেলায় ছেলেদের মত পোশাক পরতাম, ছেলেদের মত হাফ-প্যান্ট এবং টি-শার্ট আমি ক্লাস টু পর্যন্ত বাসায় পরতাম, ক্লাস থ্রীতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমার জন্য সালোয়ার-কামিজ বানানো শুরু করা হয় এবং বলা হয় যে আর একটু বড় হলে তুই বুকে ওড়না গায় দিবি, দেখতে দেখতে ২০০৫ সাল চলে এলো, আমাকে ওড়না গায় দিতে বাধ্য করা হলো, আমি তারপর ছোটো বেলার কথা ভাবা শুরু করতাম যে আমি ছেলেদের মত হাফ-প্যান্ট এবং টি-শার্ট পরতাম আর এখন কেমন যেন একটি দূর্বল পোশাক পরা শুরু করছি।


আমি আমার মা-বাবাকে এই ব্যাপারে জানালে আমার মা বলেন ঐগুলো হাফ-প্যান্ট আর টি-শার্ট তো ছেলেদের পোশাক আর তুই ক্লাস সিক্সে পড়িস, বয়স ১৩ হতে যাচ্ছে তুই হাফ-প্যান্ট পরে ছেলেদেরকে তোর পা দেখাবি? এই বছর থেকেই আমি প্রথম ব্রা পরা শুরু করি তবে প্যান্টি তখনো আমাকে কিনে দেওয়া হতোনা। একদিন আমি আমার আম্মুআব্বুর একান্ত আলোচনা শুনে ফেলেছিলাম প্যান্টির বিষয়ে, আম্মু আব্বুকে বলছিলেন আরে প্রতিভা আরেকটু বড় হোক তারপর ও নিজে নিজেই প্যান্টি কিনে নেবে। আমি ক্লাস এইটে থাকতে প্রথম প্যান্টি পরি যেটা আমার আম্মুই কিনে দিয়েছিলেন, এরপর থেকে একাদশ শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে আমি নিজেই নিজের প্যান্টি
কেনা শুরু করি।

আমাদের নারীদের শরীর একটি ট্যাবু - ঠিক আছে পোশাকের ক্ষেত্রে পুরুষদেরও আমাদের দেশের সমাজে তেমন একটা স্বাধীনতা নেই তবে তাদের শরীর এ্যাট লিস্ট ট্যাবু না, তারা বাসায় খালি গায় হয়ে থাকতে পারি আমরা পারিনা, তারা তাদের জাঙ্গিয়া ধুয়ে তারে নেড়ে রাখতে পারে আমরা পারিনা কারণ আমাদের প্যান্টি নিষিদ্ধ এবং গোপন একটা বিষয় বা লজ্জার জিনিস বা ট্যাবু। আমরা কোনো বান্ধবীর বাসায় হাফ-প্যান্ট পরে যেতে পারিনা, আমরা পারিনা সমুদ্র সৈকতে বিকিনি পরতে যেখানে পুরুষেরা ঠিকই খালি গায় এবং হাফ-প্যান্ট পরে পানিতে নামে কক্সবাজারের সৈকতে।

সব কিছুর পেছনেই কাজ করে পুরুষতান্ত্রিকতা এবং রক্ষণশীল পারিবারিক মূল্যবোধ  যেখানে নারীরা হচ্ছে শুধুই স্বামীর 'জিনিস', নারীরা হচ্ছে একটা বিশেষ প্রাণী যাদেরকে দেখলে পুরুষেরা যৌনাত্তেজনা লাভ করে এবং ধর্ষণ করতে পারে।

আমাদের সমাজে চলা এইসব ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন জরুরী। আমরা আর কত সালোয়ার-কামিজের মত দূর্বল পোশাক পরবো? আমরা কেন বুকে আলাদা একটা কাপড় (ওড়না) পরিধান করবো? কেন
আমরা পুরুষদের যৌন উত্তেজনা ওঠার অজুহাতে আমরা নিজেদেরকে বোরকা নামের একটা  বস্তায় বন্দী করে রাখবো? পুরুষদের মন-মানসিকতা পরিষ্কার করতে হবে, তাদের মাথায় 'নারীরাও মানুষ' ধারণা ঢোকাতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা মনে পড়ে গেলো বাংলাদেশের পুরুষেরা বলে যে, 'আরে মাইয়া মানুষ ভাই, হ্যায় তো এরোম কতা কোইবোই', এখানে দেখুন মেয়েদেরকে মানুষ বলা হলেও তাদেরকে 'মাইয়া মানুষ' বলে অবজ্ঞা করা হয়েছে। মানে যোনিসম্পন্ন মানুসেরা শিশ্নধারী মানুষদের চেয়ে দূর্বল  - সব দিক দিয়েই, শরীর-মনন-মেধা সব দিক দিয়েই - এটাই বাংলাদেশের পুরুষদের মগজের  ভেতরে ঢুকে যায় তাদের শৈশবকাল থেকেই।

আমি আমার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়ে  দেখেছিলাম যে ঐ বান্ধবীর ভাই বাসায় মেয়েদেরকে আসলে পর্দা করে আসতে হবে এরকম বিধান জারি করেছিলো, আবার আরেক বান্ধবীর বাসায় আমার এক ছেলে বন্ধু যেত, প্রথম  প্রথম সে তার নামে কোনো ঋণাত্মক কথা না বললেও পরে তাকে বোঝায় যে আমি ছেলেদের  সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইনা কারণ আমার প্রেমিক আছে এবং সে সবসময়ই আমার ঐ ছেলে বন্ধুটিকে বাসায় আসতে দেখলেই নিজের বুকে ওড়না ভালো করে টেনে নিত, পুরুষতন্ত্রবাদী শিক্ষা শুধু নারীদেরকে নয় ছেলেদেরকেও একভাবে অপমান করে।
নারীকে বিবেচনা, পোষাক দিয়ে না

আমি  নিজে কখনোই কোনো ঘনিষ্ঠ ছেলেবন্ধুর সামনে নিজের বুকের ওড়না ঠিক করিনা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওড়না গায়ও দেইনা, আমি এইজন্যে আমার বাবামা এবং আত্মীয়-স্বজন দ্বারা সমালোচিত হয়েছি।

আমি জানি আমার এই লেখা পড়ে অনেক নারীবাদীই আমার সমালোচনা করবেন, আমি পোশাকের স্বাধীনতা সমর্থন করি তবে এর মানে এই নয় যে বোরকা-হিজাবধারী মেয়েদেরকে আমি সমালচনা করিনা, আমি বোরকা-হিজাব ২০১২ সালে শখ করে পরেছিলাম কিছু বান্ধবীর অনুরোধে, কিন্তু বোরখা-হিজাবের ভেতরে আমি কোনো সৌন্দর্য দেখতে পাইনি, আবার শুধু লাল লাল হিজাব পরে এটার সঙ্গে ম্যাচ করে লাল সালোয়ার-কামিজ পরে ভেতরেও লাল ব্রা এবং প্যান্টি আমি পরেছিলাম আমার বান্ধবীর গিফট পেয়ে, আমার ওটা প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও কেমন যেন পুরুষতান্ত্রিক এবং যৌনঅবমাননাকর পোশাক মনে হচ্ছিলো যে আমার চুলে একটি যৌনাবেদন আছে তাই এটা গোপন রেখে পুরুষদের কৌতূহল বাড়াতে হবে।

আমরা নারী, আমরা মানুষ, আমরা টাকা দিয়ে কেনার জিনিস নই, আমরা নই শুধু স্বামীর  ভোগ্যবস্ত, আমরা কোনো সভ্য-ভদ্র পুরুষদের অপমান করতে চাইনা, তাদের সামনে  (অন্তঃত আমি) ওড়না গায়ে দিতে চাইনা - কারণ এটা একভাবে পুরুষ অবমাননা।

লেখক - তাহরীমা মনির প্রতিভা
Previous Post
Next Post
Related Posts

5 comments:

  1. প্রত্যেকটা মেয়ের এমন সাহসী মন থাকা প্রয়োজন

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর বলেছেন।

    ReplyDelete
  3. হুমায়ুন আজাদের 'নারী' বইটি পড়তে http://myallbooks.weebly.com/books/nari-by-humayun-azad লিংকে যান

    ReplyDelete
  4. বিকিনির পক্ষে কথা বলার জন্য ধন্যবাদ, অনেক নাস্তিক মেয়ে পোশাকটিকে অশ্লীল বলে চালিয়ে দেন যা মানুষের পোশাকের স্বাধীনতার বিরোধী মন্তব্য।

    ReplyDelete